ছাত্ররাজনীতির অবক্ষয় শুরু হয়েছে অনেক আগে। ছাত্রনেতারা আদর্শের পেছনে না ছুটে অর্থের পেছনে ছুটছেন।তাতে অনেক ছাত্র নেতা সফল হয়েছেন। তারা কোনো ব্যবসা বাণিজ্য না করে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।অনেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক বনে গেছেন। কেউ কেউ বড় ঠিকাদার হয়েছেন। তাদের এইউচ্চাভিলাষী মনোভাবের কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়। তাদের দলের শীর্ষনেতৃত্ব কখনোই তাদের কাছে জানতে চায়নি শুধুমাত্র ছাত্ররাজনীতি করে এত অর্থবিত্ত কোথায় পেলেন তাঁরা।
নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রণির পরপর কয়েকটি ঘটনা সংগঠনটিকে দেশব্যাপীসমালোচনার মুখে ফেলেছে। হাটহাজারীতে নিজের এক আত্মীয়কে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সহযোগিতা করতেগিয়ে রণি অস্ত্রসহ ধরা পড়েন। দুই বছরের শাস্তি হওয়া ওই ঘটনায় বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। এরপর বিজ্ঞানকলেজের অধ্যক্ষকে মারধর এবং সর্বশেষ একটি কোচিং সেন্টারের পরিচালককে মারধরের ঘটনার ভিডিওসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনার পর তিনি নিজেই দল থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। দলওতাকে অব্যাহতি দিয়েছে। কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় রণি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু এই চিত্রসর্বত্র। ছাত্র সংগঠনের পদ পাওয়ার পরপর অধিকাংশ ছাত্রনেতা বেপরোয়া হয়ে যান। তাদের বিষয়ে স্ব স্বঅভিভাবক সংগঠন কখনো ব্যবস্থা নেয় না। কোন উদ্যোগ নেয় না।
চট্টগ্রামের একাধিক সাবেক ছাত্র নেতা এ অবক্ষয়ের বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। আদর্শিক রাজনীতিথেকে বিচ্যুত হয়ে গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে ধাবিত হচ্ছেন ছাত্র সংগঠনের নেতারা। নেতৃত্ব পেয়েই অর্থের পেছনেছুটছেন। জ্যেষ্ঠদের সাথে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে পরামর্শ তো দুরের কথা সম্মানও করেন না। বরং সুযোগ পেলেঅসম্মান ও অপদস্ত করেন।
১৯৮১ সাল পর্যন্ত কলেজ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বদানকারী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেরমেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন পূর্বকোণকে বলেন, মূলত এখন পদ পদবীপেয়েই গাড়ি–বাড়ির দিকে ছুটছে কিছু ছাত্রনেতা যা ছাত্র রাজনীতির সাথে কোনভাবেই যায় না। তিনি তারছাত্ররাজনীতি জীবনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্ররাজনীতি করেছি তখন গাড়ি–বাড়ির বিষয়টিচিন্তাই করিনি।’ ছাত্রলীগে এখনো আদর্শিক নেতাকর্মী আছে উল্লেখ করে বলেন, যারা নিয়মিত ছাত্র এবং আদর্শরাজনীতি করে তাদেরকেই ফ্রন্টলাইনে নিয়ে আসতে হবে। বিবাহিত, অছাত্র, যাদের আদর্শিক চেতনা নেই– তাদেরহাতে নেতৃত্ব দিলে তারা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। এরএকটি গঠনতন্ত্র আছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠনটি পরিচালিত হলে এসব সমস্যা থাকতো না।
৮০’র দশক পর্যন্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেয়া বর্তমান চট্টগ্রাম জেলা পরিষদেরচেয়ারম্যান এমএ সালাম পূর্বকোণকে বলেন, আমরা যখন ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি তখন রাজনীতির বাইরেশুধু লেখাপড়া করতাম। সেসময় ঠিকাদারি কিংবা অন্য কোন ব্যবসার কথা ছাত্র নেতারা কখনোই চিন্তা করেনি।কিন্তু বর্তমানে তার উল্টো চিত্র। পদ পাওয়ার ৬ মাস পর থেকে ছাত্র সংগঠনের নেতারা ঠিকাদারিসহ বিভিন্নব্যবসা শুরু করে। এই কাজ করতে গিয়ে নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। মুলত আদর্শিক চেতনায় ছাত্র নেতাদের গড়েতোলা যাচ্ছে না বলে আজ ছাত্ররাজনীতির এই দশা হয়েছে। নিয়ম হলো লেখাপড়া শেষ করার সাথে সাথে ওই ছাত্রেরছাত্র রাজনীতিও শেষ হবে। তখন তিনি চাকুরি কিংবা ব্যবসা বা আয়ের পছন্দমত কোনো কর্ম বেছে নিতে পারেন।তাদেরকে আদর্শিক চেতনায় ফেরাতে অগ্রজদের ভূমিকা পালন করতে হবে। মোটিভেশন করতে হবে। ভাইয়েররাজনীতি পরিহার করতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে। তারা যেন শুধুমাত্র আদর্শের জন্যই রাজনীতি করে। অমুকভাই, তমুক ভাইয়ের গ্রুপিংয়ের জন্য নয়। তবেই পরিবর্তন আসবে।
৮৪ সালে নগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা রফিকুল হোসেন বাচ্চুর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনিবলেন, ‘এক কথায় যদি বলি, ‘আমি বলব এটা অভিভাবক সংগঠনের ব্যর্থতা।’ সন্তানের ব্যর্থতা যেভাবে পিতা–মাতার উপর আসে। তেমনি ছাত্র নেতাদের ব্যর্থতার দায়ও অভিভাবক সংগঠনের উপর বর্তায়। ওইসময় সিনিয়রনেতাদের যথেষ্ট সম্মান করা হত, এখন তা নেই। তিনি নিজেই বর্তমানে একটি ওয়ার্ডের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকরছেন উল্লেখ করে বলেন, এখনকার ছাত্রনেতাদের বললে তারা ওয়ার্ড পর্যায়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব নেবে না।তফাতটা এখানেই। অথচ সংগঠনের মূল শক্তি হল ওয়ার্ড।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম. আর. আজিম পূর্বকোণকে বলেন, ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে যারাআছেন তারা আসলে আসল জায়গায় নেই। সংগঠনের দায়িত্ব নেয়ার আগে দায়িত্ব সম্পর্কে বুঝতে হবে। দায়িত্বজ্ঞাননা থাকলে গুরুত্বপূর্ণ পদ না নেয়াই ভাল। একইভাবে যারা দায়িত্ব দেন তাদেরকে এবিষয়ে আরো বেশি বিচারবিশ্লেষণ করা উচিত। তাছাড়া পদ পাওয়ার পর সাংগঠনিক শৃঙ্খলা না মানার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ছাত্রনেতাদেররাজনৈতিক দুরদর্শীতা থাকতে হবে। নগর ছাত্রলীগের নুরুল আজিম রণি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিজ্ঞান কলেজেরবিরুদ্ধে রণির অবস্থানকে সবাই সমর্থন করেছিল। কিন্তু কাউকে মারধর করার অধিকার তার নেই। তাই একটিভাল উদ্যোগ নিয়েও সে বিতর্কিত হয়েছে। একইভাবে ইউনিএইড এর পরিচালককেও যেভাবে মারধর করেছে তাকরার অধিকার তার নেই। এই সমস্যা সমাধানে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল। ছাত্রনেতারা যখন কোনউদ্যোগ নেন কিংবা কোন সমস্যায় পড়েন তখন তাদের উচিত জ্যেষ্ঠদের পরামর্শ নেয়া। পরামর্শ নিলে এই ধরনেরসমস্যায় তা কখনোই পড়বে না।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, ছাত্রনেতা এবং কর্মীদের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করলে তাদের চরিত্রে নেতিবাচকপরিববর্তন আসবে এটা স্বাভাবিক। অপরদিকে, তদবিরের মাধ্যমে পদ–পদবী না দিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়মিতছাত্রদের দায়িত্ব দিলে তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক রাজনীতির সুফল পাওয়া যাবে। যেমনটি পাওয়া গিয়েছিল ৫২’রভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে ৯০ এর স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলন। প্রতিটি আন্দোলনেসাধারণ জনগণ ছাত্রনেতাদের বুকে টেনে নিয়েছিল। ছাত্রনেতাদের সামনে রেখে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে মানুষসম্পৃক্ত হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment